কিংবদন্তি মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী
চট্টগ্রামের ইতিহাসে বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁরা কেবলমাত্র বাংলাদেশের ইতিহাসেরই বরেণ্য ব্যক্তি নন, পুরো উপমহাদেশের সমাজজীবন ও রাজনীতিতে তাঁরা দ্যুতি ছড়িয়েছেন। এঁদের মধ্যে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী অন্যতম। তিনি এই উপমহাদেশের রাজনীতি ও সমাজ পরিবর্তনের এক বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে জন্মেছিলেন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার আড়ালিয়া গ্রামে, যা সে-সময়কার বঙ্গদেশের পূর্ব প্রান্তের চট্টগ্রাম জেলার ছোট্ট একটি অঞ্চল। কিন্তু তিনি এমন একটি পরিবারে জন্মেছিলেন, যা বংশপরম্পরায় উজ্জ্বল। তাঁর পিতা ও পিতামহ দুজনেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই কেবলমাত্র আরবি-ফার্সিতেই দক্ষ ছিলেন না, বাংলায়ও তাঁদের বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল, যেজন্য তাঁরা দুজনেই পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তাঁদের পূর্বসূরি ফতেহ মোহাম্মদ শাহ্ও ছিলেন বাংলার ইতিহাসে অতি প্রসিদ্ধ সুলতান নসরত শাহ্ কর্তৃক জায়গিরপ্রাপ্ত জায়গিরদার।
জনাব আকাশ ইকবাল রচিত ‘কিংবদন্তি মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী’ গ্রন্থ থেকে উপরে বর্ণিত তথ্যসমূহ গৃহীত। এই গ্রন্থটি কেবলমাত্র ইসলামাবাদীর সংগ্রামী জীবনকেই তুলে ধরেনি, একই সঙ্গে গ্রন্থটি তাঁর কর্মমুখর জীবনের যে সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমি উন্মোচন করেছে, তা ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের এবং তার বৃহৎ প্রেক্ষাপট হিসেবে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের এক অসাধারণ সমাজদর্পণ। এই সমাজদর্পণে, সমাজ-গবেষণায় ওঠে এসেছে, সে-সময় এই অঞ্চলের মুসলিম-সমাজ কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দৈন্যের কবলেই আচ্ছন্ন ছিল না, শিক্ষাক্ষেত্রেও তারা বিরাটভাবে পিছিয়েছিল।
বিশেষত, তাদের রাজনৈতিক চেতনা ও সমাজসচেতনতা গ্রামের বা অঞ্চলের বাইরে প্রসারিত ছিল না। মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী মাদ্রাসা শিক্ষায় খুবই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তিনি একজন ফাজিল পাশ আলিম ছিলেন। তাঁর নিজের লেখা থেকেই আমরা জানতে পারি (জনাব আকাশের তথ্যমতে), তিনি হুগলী মাদ্রাসায় আরবি-ফার্সি শিক্ষা গ্রহণের সময় দেখেছিলেন, এই শিক্ষাও কোনো গভীর শিক্ষা ছিল না। শিক্ষার্থীরা আরবি-ফার্সিতে কোনো কথা বলতেই পারত না, যদিও ১৮২৭ সাল পর্যন্ত ফার্সিই ছিল সরকারি ভাষা।
নানা তথ্যসূত্র থেকে আমরা জানি, অষ্টাদশ শতকের বাংলাদেশে ফার্সির চর্চা কেবলমাত্র মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বহু শিক্ষানুরাগী ও রাজকর্মে আগ্রহী হিন্দুও ফার্সির চর্চা করতেন। অ্যাডামসের শিক্ষাবিষয়ক রিপোর্ট অনুযায়ী, এইসময় ফার্সি জানা হিন্দুর সংখ্যা মুসলমানদের থেকে বেশি ছিল। রাজা রামমোহন রায়ের প্রকাশিত প্রথম পত্রিকাটি ফার্সিতেই লেখা। অনেক হিন্দু পণ্ডিত মুন্সী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেমন, অনেক আরবি-ফার্সি জানা মুসলমান, যাঁরা বাংলা রচনায় দক্ষ ছিলেন, তাঁরা পণ্ডিত হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পিতা, পিতামহ দুজনেই পণ্ডিত আখ্যা অর্জন করেছিলেন।
জনাব আকাশ ইকবাল তাঁর এই গ্রন্থে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন, মৌলানা ইসলামাবাদী আজীবন ইসলামের একজন একনিষ্ঠ সেবক এবং ইসলাম প্রচারে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করা সত্ত্বেও তাঁর মানসিক জগৎ ও জীবনচিন্তা ছিল অসাম্প্রদায়িক এবং অসাধারণভাবে বৈশ্বিক। তিনি তৎকালীন মুসলিম-সমাজকে ইসলামের ইতিহাস ও বিশ্ব-ইতিহাস জানানোর জন্য অনন্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। এমনকি এ কারণে তিনি সাংবাদিকও হয়েছিলেন। বের করেছিলেন সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন। ইসলামাবাদীর ইতিহাস-চেতনা কেবলমাত্র জ্ঞানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ভারতবর্ষকে, এই উপমহাদেশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য তৎকালীন প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে নিজেকে বিপুলভাবে সম্পৃক্ত করেছিলেন। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনে তিনি নিজেকে এত গভীরভাবে জড়িত করেছিলেন যে, তাঁকে কারাভোগও করতে হয়েছিল। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গেও একসময় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। কিন্তু মুসলিম লীগের রাজনীতি তাঁকে আলোড়িত করতে ব্যর্থ হয় একারণে যে, তিনি এই রাজনীতিতে গরিব কৃষক, গরিব শ্রমিকের স্বার্থের বদলে মুসলিম জমিদার ও জোতদারদের শ্রেণিস্বার্থের প্রতিফলনই বেশি দেখেছিলেন (পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে বঙ্গবন্ধুও প্রায় একই চেতনার অংশীদার হয়েছিলেন)।
১৯৩০ সালে ইসলামাবাদী মুসলিম লীগ ত্যাগ করে গরিব জনগণের স্বার্থে কৃষক-প্রজা দলে যোগদান করেন। তাঁর জীবনব্যাপী সাধনা ছিল কীভাবে গরিব জনগণকে দৈন্যের বন্ধন থেকে মুক্ত করা যায়। আজকের কদম মোবারক এতিমখানা, কদম মোবারক স্কুল এই সাধনা থেকে উদ্ভূত। শৈশবোত্তীর্ণ কৈশোরে পিতৃমাতৃহীন ইসলামাবাদী অনুভব করেছিলেন, অনাথ শিশু-কিশোরদের অসহনীয় অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার পথ অনুসন্ধান করতে হবে। অনাথ শিশু-কিশোরদের প্রতি এই গভীর মমত্ববোধ ইসলামাবাদী আজীবন লালন করেছেন। তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন, কদম মোবারক এতিমখানা একদিন বিরাট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। তাঁর এই প্রত্যাশা আজও পূর্ণ পরিণতি পায়নি। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাঁর এই স্বপ্নকে পূরণ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করবে।
ইসলামাবাদী ছিলেন একজন রাজনীতিসচেতন পূর্ণ মানুষ। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, এদেশের মানুষ যেন সার্বিকভাবে ঔপনিবেশিক শোষণমুক্ত হয়। সেইজন্য তিনি মুসলিম লীগের ব্রিটিশ রাজতোষণ নীতি যেমন পছন্দ করেননি তেমনি কংগ্রেসের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনকেও তিনি ঔপনিবেশিক শাসকদের এই উপমহাদেশ থেকে বিতাড়নের জন্য উপযুক্ত পন্থা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। স্মরণীয় ১৯৩০-৩৪ সালে চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম, যা বিশ্ব-ইতিহাসে একটি অনন্য উদাহরণ এই কারণে যে, এই বিপ্লবীরা তৎকালীন ব্রিটিশরাজের ইতিহাসে তাদের অধিকৃত একটি ভূমি বা অঞ্চলকে চার দিনের জন্য উন্মুক্ত ও স্বাধীন রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সেজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুভাষ চন্দ্র বসু যখন ব্রিটিশদের বিতাড়নের জন্য আজাদ-হিন্দ ফৌজ গঠন করলেন সুদূর জাপানে এবং একসময় যখন আজাদ-হিন্দ ফৌজ প্রায় ইম্পল পর্যন্ত পৌঁছে যায় তখন মৌলানা ইসলামাবাদী সুভাষ চন্দ্র বসুর এই উদ্যোগের প্রতি যে-গোপন সহায়তার হস্ত প্রসার করেছিলেন, তা তাঁর অতলান্ত গভীর দেশপ্রেম থেকেই সঞ্জাত। এরজন্য তিনি বিরাট মূল্যও দিয়েছেন। দিল্লি ও পাঞ্জাবের ব্রিটিশ কারাগারে তাঁর উপর অবর্ণনীয় শারীরিক অত্যাচার চালানো হয়েছিল।
ইসলামাবাদী প্রকৃত অর্থেই এক অসাধারণ মানব। ধর্মে তাঁর ছিল অটল বিশ্বাস। মানুষের প্রতিও ভালোবাসা ছিল তাঁর অন্তহীন। দেশপ্রেমেও তিনি জীবন উৎসর্গ করতে ছিলেন সদা প্রস্তুত। শিক্ষার প্রতি তাঁর অনুরাগও ছিল তুলনাহীন। তিনি এদেশের মানুষকে ‘মনুষ্যত্বে’ উজ্জ্বীবিত করতে শিক্ষাকে পাথেয় হিসেবে দেখেছিলেন।
জনাব আকাশ ইকবালের ‘কিংবদন্তি মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী’ গ্রন্থে ইসলামাবাদীর অসাধারণ চারিত্রিক অবয়বকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা মৌলানা ইসলামাবাদী সম্পর্কে যথার্থই একটি অমূল্য গবেষণা গ্রন্থ।
আমার কামনা, এই গ্রন্থটি আমাদের তরুণ-সমাজকে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমে উদ্দীপিত করে বাংলাদেশকে একটি মানবিক সমাজে রূপান্তরে প্রেরণা দিক।প্রফেসর ড. অনুপম সেন
উপাচার্য
প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি
চট্টগ্রাম।


কিংবদন্তি মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী
৳ 600.00 Original price was: ৳ 600.00.৳ 490.00Current price is: ৳ 490.00.
লেখক : আকাশ ইকবাল
প্রকাশনী : অক্ষরবৃত্ত
বিষয় : ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, মুসলিম ব্যক্তিত্ব
পৃষ্ঠা : 336, কভার : হার্ড কভার, সংস্করণ : 1st Published, 2023
আইএসবিএন : 9789849614508, ভাষা : বাংলা
Related products
SEO এবং অনলাইনে জীবন বদলের গল্প
আমার হজ
এক পলকে গিট ও গিটহাব
এমপ্লয়াবিলিটি
ক্যারিয়ার এক্সসিলেন্স
ক্যারিয়ার ভাবনায় বই
সেলফ কনফিডেন্স:
আমরা মুসলিম। মুসলিম হিসেবে আমরা কিছু মৌলিক বিশ্বাস এবং আদর্শ ধারণ করি। আমাদের এই বিশ্বাস মোতাবেকই আমরা আমাদের জীবন পরিচালনা করি। তাই আত্মবিশ্বাস অর্জনের যেসব পদ্ধতি আছে, তার চেয়ে আমাদের অনুসৃত পদ্ধতি ভিন্ন হবে। আমরা তা নিরূপণ ও অনুসরণ করব আমাদের আদর্শের আলোকে। সেক্যুলার চিন্তাবিদরা মানুষকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্বশীল সত্তা মনে করেন। মানুষের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করাটাকেই তারা জীবনের মূল উদ্দেশ্য মনে করেন। অন্যদিকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করলে আমরা কেবলই আল্লাহর দাস। তাঁর দেওয়া বিধান অনুসরণ করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করাটাই হলো আমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য।ক্যারিয়ার হ্যাকস:
প্রশিক্ষণ, পড়াশোনা, আর অভিজ্ঞতা থেকে যত শিখছি ততই মনে হচ্ছে ইশ এই জিনিসগুলো যদি আরো আগেই শিখতে পারতাম তাহলে হয়তো ক্যারিয়ারে আরেকটু ভাল পজিশনে থাকতে পারতাম। হ্যাঁ বন্ধুরা, ক্যারিয়ারে তোমার ভাল পজিশনিং এর জন্য যা যা দরকার তাই থাকছে এই বইটিতে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি সমিক্ষা বলছে প্রায় ৪৭ শতাংশ শিক্ষিত জনগোষ্ঠি বেকার। তোমার অবস্থানটি এই ৪৭ শতাংশের মধ্যে দেখতে না চাইলে এখন থেকেই শুরু করতে হবে তোমার ক্যারিয়ার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। কিভাবে করবে? কোত্থেকে শুরু করবে? কি কি করবে? এগুলোর উত্তর নিয়েই বইটি।স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
চাপে নেই এমন মানুষ আসলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর । বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসে বিক্রয় কর্মীদের নানারকম স্ট্রেস সামলাতে হয়, স্ট্রেস সামলাতে হয় বিভাগীয় প্রধান থেকে একজন সিইওকে । উদ্যোক্তাদের চাপের কোনো শেষ নেই । আবার যারা নতুন ক্যারিয়ার তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু ব্যাটে-বলে হচ্ছে না, তাদের চাপও কম নয় । ব্যক্তিজীবনে সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকেও অনেকে চাপে ভোগেন ।
এই বই যারা পড়বেন তার অন্তত ১০ শতাংশ পাঠক যদি হ্যাকস গুলো অনুসরণ করে উপকৃত হন, চাপ সামলানোর কৌশল রপ্ত করে সন্তুষ্ট জীবন খুঁজে পান, তবেই আমার লিখার স্বার্থকতা ।আমি জীবনে মূলত পারপাস পেছনে কাজ করি । এই বই সেই পারপাসের একটা অংশ ।
মুমিনের ক্যারিয়ার ভাবনা:
কেমন হবে একজন খাঁটি মুমিনের ক্যারিয়ার? কী হবে তার জীবনের লক্ষ? ক্যারিয়ার মানেই আমরা বুঝি টাকা এবং সম্মান। ক্যারিয়ারের মধ্য দিয়ে মানুষ সম্মান খোঁজে, ক্যারিয়ারের মধ্য দিয়ে মানুষ টাকা খোঁজে। কিন্তু ক্যারিয়ারের মধ্য দিয়ে সম্মান খোঁজা, ক্যারিয়ারের মধ্য দিয়ে টাকা খোঁজা, এটা মুমিনের লক্ষ হতে পারে না। কারণ, মুমিন বিশ্বাস করে, টাকা আসে আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে। রিজিক আসে আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে এবং সম্মানও আসে আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে। আল্লাহ তাআলা রিজিকেরও মালিক, সম্মানেরও মালিক।ডেটা অ্যানালাইসিস ও ভিজ্যুয়ালাইজেশনে পাইথনের ব্যবহার
প্রোডাক্টিভ প্রোগ্রামার
© 2024 Thebookcenterbd All rights reserved | Developed By Deshi IT
Reviews
There are no reviews yet.